সন্তানকে দুধ পান করিয়ে স্বামীর কাছ থেকে বিনিময় গ্রহন
তাফসিরে মারেফুল কুরআন থেকে
وَالۡوَالِدٰتُ یُرۡضِعۡنَ اَوۡلَادَہُنَّ حَوۡلَیۡنِ کَامِلَیۡنِ لِمَنۡ اَرَادَ اَنۡ یُّتِمَّ الرَّضَاعَۃَ ؕ وَعَلَی الۡمَوۡلُوۡدِ لَہٗ رِزۡقُہُنَّ وَکِسۡوَتُہُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ لَا تُکَلَّفُ نَفۡسٌ اِلَّا وُسۡعَہَا ۚ لَا تُضَآرَّ وَالِدَۃٌۢ بِوَلَدِہَا وَلَا مَوۡلُوۡدٌ لَّہٗ بِوَلَدِہٖ ٭ وَعَلَی الۡوَارِثِ مِثۡلُ ذٰلِکَ ۚ فَاِنۡ اَرَادَا فِصَالًا عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡہُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡہِمَا ؕ وَاِنۡ اَرَدۡتُّمۡ اَنۡ تَسۡتَرۡضِعُوۡۤا اَوۡلَادَکُمۡ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ اِذَا سَلَّمۡتُمۡ مَّاۤ اٰتَیۡتُمۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ وَاتَّقُوا اللّٰہَ وَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
অর্থঃ মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’ বছর দুধ পান করাবে। (এ সময়কাল) তাদের জন্য, যারা দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। সন্তান যে পিতার, তার কর্তব্য ন্যায়সম্মতভাবে মায়েদের খোরপোষের ভার বহন করা। ১৭৩ (হাঁ) কাউকে তার সামর্থ্যরে বাইরে ক্লেশ দেওয়া হয় না। মাকে তার সন্তানের কারণে কষ্ট দেওয়া যাবে না এবং পিতাকেও তার সন্তানের কারণে নয়। ১৭৪ অনুরূপ দায়িত্ব ওয়ারিশের উপরও রয়েছে। ১৭৫ অতঃপর তারা (পিতা-মাতা) পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে (দু’ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই) যদি দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাতেও তাদের কোনও গুনাহ নেই। তোমরা যদি তোমাদের সন্তানদেরকে (কোন ধাত্রীর) দুধ পান করাতে চাও, তাতেও তোমাদের কোনও গুনাহ নেই যদি তোমরা ধার্যকৃত পারিশ্রমিক (ধাত্রীমাতাকে) ন্যায়ভাবে আদায় কর এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো এবং জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ ভালোভাবে দেখছেন।
মায়েরা নিজের সন্তানদিগকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্যদান করবে। (এ সময়টি তার জন্য) যে স্তন্যদানের সময় পূর্ণ করতে চায়। আর সন্তান যার, তার দায়িত্ব রয়েছে সেই মাতার ভরণ-পোষণ ও পোশাক-পরিচ্ছদ (ইত্যাদি), প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এবং কোন ব্যক্তিকে কোন আদেশ দেওয়া হয় না, কিন্তু তার ক্ষমতানুযায়ী, কোন মাতাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না তার বাচ্চার জন্য। (যদি পিতা জীবিত না থাকে) বর্ণিত পন্থানুযায়ী (তাহলে বাচ্চার লালন-পালনের ব্যবস্থা) তার নিকটবর্তী আত্মীয়ের দায়িত্ব। (শরীয়তানুযায়ী যে ব্যক্তি বাচ্চার উত্তরাধিকারী হয়। অতঃপর বুঝে নাও যে,) যদি পিতা-মাতা দু’বছর পূর্ণ হবার আগেই বাচ্চার দুগ্ধপান বন্ধ করতে চায় পরস্পর সন্তুষ্টি ও পরামর্শক্রমে, তবে তাতেও তাদের কোন গোনাহ হবে না। আর যদি তোমরা (মাতা-পিতা থাকা সত্ত্বেও কোন উপকারের জন্য যেমন, মায়ের দুধ যদি এমন হয় যে, এতে বাচ্চার ক্ষতি হয় তবে) বাচ্চাকে অন্য কোন ধাত্রীর দুধ পান করাতে চাও, তবে তাতেও তোমাদের কোন গোনাহ হবে না। যদি তাকে সে ধাত্রীর তত্ত্বাবধানে দিতে চাও, তাকে যা দেওয়ার চুক্তি হবে তা নিয়মানুযায়ী দিতে হবে। বস্তুত আল্লাহ্কে ভয় কর এবং স্মরণ রেখ যে, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের কাজকর্মের সব খবরই রাখেন।
এ আয়াতে স্তন্যদান সম্পর্কিত নির্দেশাবলী বর্ণিত হয়েছে। এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আয়াতে তালাক সংক্রান্ত আদেশাবলীর আলোচনা হয়েছে। এরই মধ্যে শিশুকে স্তন্যদান সংক্রান্ত আলোচনা এজন্য করা হয়েছে যে, সাধারণত তালাকের পরে শিশুর লালন-পালন ও দুধপান নিয়ে বিবাদের সৃষ্টি হয় । কাজেই এ আয়াতে এমন ন্যায়সঙ্গত নিয়ম বাতলে দেওয়া হয়েছে যা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সহজ ও যুক্তিসঙ্গত। বিয়ে বহাল থাকাকালে স্তন্যদান বা দুধ ছাড়ানোর বিষয় উপস্থিত হোক অথবা তালাক দেওয়ার পর, উভয় অবস্থাতেই এমন এক ব্যবস্থা বাতলে দেওয়া হয়েছে, যাতে কোন ঝগড়া-বিবাদ বা কোন পক্ষের উপরই অন্যায় ও জুলুম হওয়ার পথ না থাকে। আয়াতের প্রথম বাক্যে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ
অর্থাৎ—মাতাগণ নিজেদের বাচ্চাদেরকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্যপান করাবে যদি কোন বিশেষ অসুবিধা এ সময়ের পূর্বে স্তন্যদানে বিরত থাকতে বাধ্য না করে।
এ আয়াত দ্বারা স্তন্যদানের সব কয়টি মাস’আলা বোঝা গেল।
শিশুদের স্তন্যদান মায়ের উপর ওয়াজিবঃ প্রথমত এই যে, শিশুকে স্তন্যদান মাতার উপর ওয়াজিব। কোন অসুবিধা ব্যতীত ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বা অসন্তুষ্টির দরুন স্তন্যদান বন্ধ করলে গোনাহ হবে এবং স্তন্যদানের জন্য স্ত্রী স্বামীর নিকট থেকে কোন প্রকার বেতন বা বিনিময় নিতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত বিবাহ বন্ধন বিদ্যমান থাকে। কেননা, এটা স্ত্রীরই দায়িত্ব।
দ্বিতীয়ত, পূর্বেই স্থির হয়েছে যে, স্তন্যদানের পূর্ণ সময় দু’বছর। যদি কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে বন্ধ করার প্রয়োজন না হয়, তবে তা বাচ্চার অধিকার।
এতে একথাও বোঝা যাচ্ছে যে, স্তন্যদানের সময়সীমা দু’বছর ঠিক করা হয়েছে। এরপর মাতৃস্তনের দুধ পান করানো চলবে না। তবে কোরআনের কোন কোন আয়াত এবং হাদীসের আলোকে ইমাম আবূ হানীফা (র) শিশুর দুর্বলতার ক্ষেত্রে ত্রিশ মাস বা আড়াই বছর পর্যন্ত এ সময়সীমাকে বর্ধিত করেছেন। আড়াই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর শিশুকে মাতৃস্তন্যের দুধপান করানো সকলের ঐকমত্যে হারাম। এ আয়াতের দ্বিতীয় বাক্যে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا
অর্থাৎ—“নিয়মানুযায়ী মাতার খাওয়া-পরা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা সন্তানের পিতার দায়িত্ব। কাকেও সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে কোন আদেশ দেওয়া হয় না।”
এতে প্রথমত লক্ষণীয় এই যে, মাতাগণের উদ্দেশ্যে কোরআন মজীদে والجات শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, পিতার জন্য সংক্ষিপ্ত শব্দ والد কে বাদ দিয়ে المولود له ব্যবহার করা হয়েছে অথচ কোরআনের অন্যত্র والد শব্দের ব্যবহারও রয়েছে। যেমন لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ অবশ্য এক্ষেত্রে والد এর পরিবর্তে مَوْلُودٌ لَهُ ব্যবহার করার একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, সমগ্র কোরআনেরই এক বিশেষ বর্ণনাভঙ্গি রয়েছে যে, কোরআন কোন বিধানকে দুনিয়ার আইনের বর্ণনা পদ্ধতি অনুযায়ী বিবৃত করে না; বরং অভিভাবকসুলভ সহানুভূতির ভঙ্গিতে এমনভাবে বর্ণনা করে, যাকে গ্রহণ করা এবং সেমতে কাজ করা মানুষের পক্ষে সহজ হবে।
এখানেও বাচ্চার খোরাক পিতার দায়িত্বে রাখা হয়েছে, অথচ সে পিতা-মাতার যৌথ সম্পদ। এতে পিতার পক্ষে এ আদেশকে বোঝা মনে না করা সম্ভব ছিল। তাই والد শব্দের স্থলে مَوْلُودٌ لَهُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ সেই শিশু যার জাত। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শিশুর লালন-পালন পিতা-মাতা উভয়েরই দায়িত্ব, কিন্তু শিশু পিতার বলেই অভিহিত হয়ে থাকে, পিতার বংশেই শিশুর বংশ পরিচয় হয়ে থাকে। যেহেতু শিশু পিতার, সুতরাং খরচের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা মানুষের পক্ষে সহজ হবে।
শিশুকে স্তন্যদান মাতার দায়িত্ব আর মাতার ভরণ-পোষণ পিতার দায়িত্বঃ এ আয়াতের দ্বারা একথাও বোঝা যাচ্ছে যে, শিশুকে স্তন্যদান করা মাতার দায়িত্ব; আর মাতার ভরণ-পোষণ ও জীবন ধারণের অন্যান্য যাবতীয় খরচ বহন করা পিতার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত বলবৎ থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত শিশুর মাতা স্বামীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বা তালাক-পরবর্তী ইদ্দতের মধ্যে থাকে। তালাক ও ইদ্দত অতিক্রান্ত হয়ে গেলে স্ত্রী হিসাবে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় সত্য, কিন্তু শিশুকে স্তন্যদানের পরিবর্তে মাতাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে।-(মাযহারী)
স্ত্রীর খরচ স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী হবে, না স্ত্রীর মর্যাদা অনুসারে হবেঃ শিশুর পিতা-মাতা উভয়ই যদি ধনী হয়, তবে ভরণ-পোষণও ধনী ব্যক্তিদের মত হওয়া ওয়াজিব। আর দু’জনই গরীব হলে গরীবের মতই ভরণ-পোষণ দিতে হবে। দু’জনের আর্থিক অবস্থা যদি ভিন্ন ধরনের হয়, তবে এক্ষেত্রে ফকীহগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। হেদায়া প্রণেতা বলেছেন, যদি স্বামী ধনী হয় এবং স্ত্রী দরিদ্র হয়, তবে এমন মানের খোরপোশ দিতে হবে, যা দরিদ্রদের চাইতে বেশি এবং ধনীদের চাইতে কম।
ইমাম কারখী বলেছেন যে, স্বামীর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খোরপোশ নির্ধারণ করতে হবে।
ফতহুল কাদীরে এ মতের সমর্থনে বহু ফকীহর ফতোয়া উদ্ধৃত করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে স্তন্যদান সংক্রান্ত বিধি-বিধান বর্ণনার পর ইরশাদ হয়েছেঃ
لَا تُضَارَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلَا مَوْلُودٌ لَهُ بِوَلَدِهِ
অর্থাৎ—“কোন মাতাকে তার শিশুর জন্য কষ্ট দেওয়া যাবে না। আর কোন পিতাকেও এর জন্য কষ্ট দেওয়া যাবে না।" অর্থাৎ শিশুর পিতা-মাতা পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ করবে না। যেমন, মাতা যদি স্তন্যদান করতে অপারক হয়, আর যদি পিতা মনে করে, যেহেতু শিশু তারওঁ বটে, কাজেই তার উপর চাপ সৃষ্টি করা চলে। কিন্তু না, অপারক অবস্থায় মাতাকে স্তন্যদানে বাধ্য করা যাবে না। অথবা পিতা দরিদ্র এবং মাতার কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও স্তন্যদানে অস্বীকার করে যে, শিশু যেহেতু পিতার, কাজেই অন্য কারো দ্বারা দুধ পান করানোর ব্যবস্থা করা হোক, এমন মানসিকতা প্রদর্শন করাও সঙ্গত হবে না।
মাতাকে স্তন্যদানে বাধ্য করা না করার বিবরণঃ পঞ্চম মাস’আলাঃ لَا تُضَارَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا এতে বোঝা যায় যে, মা যদি কোন অসুবিধার কারণে শিশুকে স্তন্যদান করতে অস্বীকার করে, তবে শিশুর পিতা তাকে এ ব্যাপারে বাধ্য করতে পারবে না। অবশ্য শিশু যদি অন্য কোন স্ত্রীলোকের বা কোন জীবের দুধ পান না করে, তবে মাতাকে বাধ্য করা চলে।
বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ থাকা পর্যন্ত হুকুমঃ ষষ্ঠ মাস’আলা মাতা শিশুকে স্তন্যদানের জন্য বিবাহ-বন্ধন বহাল থাকাকালে এবং তালাক-পরবর্তী ইদ্দতের সময়ে কোন পারিশ্রমিক দাবি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তার খোরপোশ যা শিশুর পিতা স্বাভাবিকভাবে বহন করে তা-ই যথেষ্ট; অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবি করা পিতাকে কষ্ট দেওয়া বৈ কিছু নয়। আর তালাকের ইদ্দত অতিক্রান্ত হয়ে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবার পরেও যদি তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী শিশুকে স্তন্যদান করতে থাকে, তবে সে এজন্য শিশুর পিতার কাছে পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে এবং পিতাকে তা দিতে বাধ্য করা হবে। কেননা, এ দায়িত্ব বহন না করায় মায়ের ক্ষতি হয়। তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, এ পারিশ্রমিক অন্যান্য স্ত্রীলোক সাধারণত যা পেয়ে থাকে, তা-ই পাবে। যদি এর চাইতে বেশি দাবি করে, তবে পিতা অন্য ধাত্রী দ্বারা দুধ পান করানোর কাজ সমাধা করার অধিকারী হবে।
এতীম শিশুদের দুধ পান করানোর দায়িত্ব কার ? ইরশাদ হয়েছেঃ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَلِكَ অর্থাৎ যদি শিশুর পিতা জীবিত না থাকে তখন যে ব্যক্তি শিশুর প্রকৃত উত্তরাধিকারী, তিনি তার দুধ পান করানোর দায়িত্ব বহন করবেন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি পিতৃহীন শিশুর সঠিক উত্তরাধিকারী, তিনিই দুগ্ধ, ধাত্রীমাতা বা ধাত্রীদের খোরপোশ বা পারিশ্রমিকের দায়িত্ব নেবেন। এমন উত্তরাধিকারী যদি একাধিক থাকে, তবে প্রত্যেকে তার মীরাসের অংশের অনুপাতে খরচ বহন করবে।
ইমাম আবূ হানীফা (র) বলেছেন যে, এতীম শিশুর দুধ পানের ব্যয় বহনের দায়িত্ব উত্তরাধিকারীদের উপর অর্পণ করাতে একথাও বোঝা গেল যে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের ব্যয়ভার দুধ পান শেষ হওয়ার পরেও তাদের উপরেই বর্তাবে। কেননা, এখানে দুধের কোন বিশেষত্ব নেই, উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুর ভরণ-পোষণ। যদি এতীম শিশুর মা ও দাদা জীবিত থাকেন, তবে তারাই শিশুর মোহরেম ও উত্তরাধিকারী। অতএব, তার ভরণ-পোষণ মীরাসের অংশের অনুপাতে তাদের উপরই ন্যস্ত হবে। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ খরচ মাতা এবং দুই-তৃতীয়াংশ খরচ দাদা বহন করবেন। এতে এ কথাও বোঝা গেল যে, এতীম নাতির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দাদার উপর দাদার অন্যান্য সন্তানের চাইতেও বেশি। কেননা, প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের ভরণ-পোষণ তার উপর ওয়াজিব নয়। কিন্তু না-বালেগ এতীম নাতির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর ওয়াজিব। তবে সম্পত্তিতে পুত্রদের জীবিত থাকাকালে নাতিকে অংশীদার করা মীরাসের আইনের পরিপন্থী । কারণ নিকটবর্তী সন্তান থাকা অবস্থায় দূরবর্তী সন্তানকে মীরাস দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে যদি প্রয়োজন মনে করেন, তবে দাদা এতীম নাতির জন্য কিছু ওসীয়ত করবেন এবং সে অধিকার তাঁর আছে। এ ওসীয়তের পরিমাণ সন্তানদের অংশ হতে বেশিও হতে পারে। এভাবে এতীম নাতির প্রয়োজনও পূর্ণ করা হবে এবং মীরাস আইন মোতাবেক নিকটতম ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তীকে অংশ না দেওয়ার বিধানটিও রক্ষা হবে।
স্তন্যদান বন্ধ করার আদেশঃ অতঃপর আলোচ্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ
فَإِنْ أَرَادَا فِصَالًا عَنْ تَرَاضٍ مِنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا
অর্থাৎ—যদি শিশুর পিতা-মাতা পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শের ভিত্তিতে স্তন্যপানের সময়সীমার মধ্যেই স্তন্যপান বন্ধ করা সাব্যস্ত করে এবং তা মায়ের কোন অসুবিধার জন্যই হোক বা শিশুর কোন রোগের জন্যই হোক, তাতে কোন পাপ নেই। এখানে ’পরস্পর সম্মতি ও পরামর্শের’ শর্ত আরোপ করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, স্তন্যদান বন্ধ করার ব্যাপারটিও সন্তানের মঙ্গলের উদ্দেশ্যেই হতে হবে, পরস্পরের ঝগড়া-বিবাদের কারণে শিশুর ক্ষতি করা যাবে না।
মা ছাড়া অন্য স্ত্রীলোকের দ্বারা স্তন্যপান করানোর হুকুমঃ ইরশাদ হয়েছেঃ
وَإِنْ أَرَدْتُمْ أَنْ تَسْتَرْضِعُوا أَوْلَادَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُمْ مَا آتَيْتُمْ بِالْمَعْرُوفِ
অর্থাৎ—যদি তোমরা কোন মঙ্গলের উদ্দেশ্যে শিশুকে মা ছাড়া অন্য কোন স্ত্রীলোকের দুধ পান করাতে চাও, তবে তাতে কোন গোনাহ নেই। তবে এর শর্ত হচ্ছে এই যে, স্তন্যদানকারিণী ধাত্রীর যে পারিশ্রমিক সাব্যস্ত করা হবে তা পুরোপুরিভাবে প্রদান করতে হবে। যদি তাকে নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়া না হয়, তবে সে অপরাধের গোনাহ তার উপর থাকবে।
এতে আরো একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, সে স্ত্রীলোককে পারিশ্রমিকের কথা পূর্ণভাবে পরিষ্কার করে ঠিক করে দিতে হবে, যাতে পরে কোন রকম বিবাদ সৃষ্টি না হয় এবং নির্ধারিত সময়ে তার এ পারিশ্রমিকও আদায় করে দিতে হবে। এতে টালবাহানা করা চলবে না।
দুধ পানের ব্যাপারে এসব আহকাম বর্ণনা করার পর কোরআনের নিজস্ব বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী বিধি-বিধানের উপর আমল করার জন্য এবং সর্বাবস্থায় এর উপর অটল থাকার জন্য আল্লাহর ভয় এবং তিনি যে সর্বজ্ঞানের অধিকারী এ ধারণা পেশ করেছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
অর্থাৎ—আল্লাহকে ভয় করো এবং মনে রেখ, তিনি তোমাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং প্রকাশ্য ও গোপন যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত। যদি কেউ দুধ পান বা দুধ ত্যাগের ব্যাপারে আলোচ্য নিয়মের পরিপন্থী কিছু করে অথবা শিশুর মঙ্গল-অমঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য না রেখে এ সম্পর্কে মনগড়া কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তবে সে সাজা ভোগ করবে।
No comments