Header Ads

নারী কন্যা জায়া জননী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলুহিল কারীম। আম্মা বাদ। পর্দার বিধান ইসলামের এক চিরন্তন ও সার্বজনীন বিধান। সাধারণ সমাজ ব্যবস্থা এবং উম্মতের মায়েদের জন্য অনেক বড় ইহসান। এই বিধানের মাধ্যমে মূলত ইসলামি শরিয়তের যর্থাথতা, পরিপূর্ণতা এবং উন্নত রুচিশীলতার স্ফুরণ ঘটেছে। পর্দা নারী জাতির নিরাপত্তার একমাত্র প্রতীক। নারীর মর্যাদা এবং ইজ্জত ও ইফ্ফতের প্রধান সোপান। কোরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তায়ালা পর্দার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং পর্দা লঙ্ঘণের ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। হাদিস শরিফের অসংখ্য বর্ণনায়ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আধুুনিক শিক্ষিত সমাজ এবং ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত একটি বিশেষ শ্রেণি, ‘ইসলামই সর্বাধুনিক জীবনব্যবস্থা’ এই চিরন্তন সত্য বাণীর আড়ালে ভিন্ন কিছু খোঁজার চেষ্টা করেন। ‘একাবিংশ শতাব্দির এই যুগে, বৈশি^ক উন্নতির এই সময়ে নারীদের ঘরে বসিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই! এটা পশ্চাৎপদতা!! এটা উন্নয়ন বিমুখতা!!! ইত্যদি মুখরোচক শ্লোগান তুলেও তারা নারীদের উন্মুক্ত চলাফেরা ও পুরুষের সমন্বিত কর্মক্ষেত্রের সুযোগ করে দিচ্ছেন। ইদানিংকালে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো কোনো কর্তা ব্যক্তিরাও উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা রা. এর ব্যবসা করা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে হযরত আয়েশা রা. এর সহযোগিতা করাকে নারীদের অবাদে চলাফেরা ও পুরুষের সাথে সমানতালে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহনের প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চাচ্ছেন। যার ফলে পর্দার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

    শরিয়ত যদিও মহিলাদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে তাদের গৃহকেই নির্বাচন করেছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীরা আর ঘরে বসে নেই। বরং প্রতিনিয়ত তারা বাইরে যাতায়াত করেই চলছে। তাই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, যে মহিলাদের পর্দা বা হিযাব কতটুকু? 

উন্মুক্ত স্থানে, পরপুরুষের সামনে, স্কুল-কলেজ, অফিস আদালতে তারা কি চেহারা খুলতে পারবে? কেননা অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এসকল ক্ষেত্রে অনেক নারীই চেহারা খুলতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে কিংবা মুখ ঢেকে রাখার কারণে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। নিন্মোক্ত আলোচনায় আমরা বিষটি সমাধানের চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।


পর্দাই নারীর ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ

ছবি:pexels.com
    
পর্দা সম্পর্কিত সর্বপ্রথম আয়াত হচ্ছে সুরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যক্ষভাবে নবীপত্মীদের এবং প্ররোক্ষভাবে উম্মতের সকল নারীদের সম্ভোধন করে নির্দেশ দিয়েছেন 

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى

অর্থাৎ তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের নারীদের ন্যায় সাজ-সজ্জা প্রদর্শন করে বাইরে বেরিয়ে পড়ো না। (সুরা আহযাব, আয়াত:৩৩) এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নারী জাতির সৃষ্টির মৌলিক উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এবং আয়াতের শেষাংশে একথাও বলে দিয়েছেন যে, ‘হে নবীর পরিবার!

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا

নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে তোমাদের পুত-পবিত্র করতে চান। আয়াতের প্রথমাংশ এবং শেষাংশ দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, নারী জতির প্রবিত্রতা একমাত্র পর্দার মাঝেই নিহিত। পর্দাই নারীর ইজ্জতের রক্ষাকবচ। 


চেহারারও পর্দা আছে 

এক. কুরআনুল কারীমের সুরাতুল আহযাবের ৫৯নং আয়াত আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,

 يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا (৫৯)  

অর্থ: হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং জগতের সকল নারীদের লক্ষ করে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আর নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু’। 


جَلَابِيبِ শব্দের ব্যাখ্যা

এই আয়াতে চেহারার পর্দা সংশ্লিষ্ট শব্দ হচ্ছে  جَلَابِيبِ শব্দটি। তাই প্রথমে আমরা جَلَابِيبِ শব্দের মৌলিক অর্থ জেনে নিব।

جَلَابِيبِ কাকে বলে

جَلَابِيبِ শব্দটি جلباب  শব্দের বহুবচন। আল্লামা রাগেব ইস্পাহানি রহ. (মৃত: ৫০৬) তার কুরআনিক অভিধানগ্রন্থ (المفردات في غريب القرآن)- এ جَلَابِيبِ  শব্দের আনুবাদ করেছেন الخُمُرُ বলে। (আলমুফাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃষ্ঠা: ১০২ মাকতাবা তাওফিকিয়্যাহ) আর তাঁরই ভাষ্যমতে-

الخمار في التعارف إسما لما تغطي به المرأة رأسها

অর্থাৎ খিমার বলা হয় এমন কাপড় যা দিয়ে মহিলারা মাথা ঢেকে রাখে। (আলমুফাদাত,পৃষ্ঠা:১৬৫) 

আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধানগ্রন্থ ‘লিসানুল আরবে’ جلباب শব্দে অর্থে বলা হয়েছে,

الجلباب: ثوب أوسع من الخمار دون الرداء. تغطي به المرأة رأسها و صدرها.

অর্থাৎ جلباب বলা হয় এমন কাপড় যা ওড়না থেকে বড় এবং চাদর থেকে ছোট। যা দিয়ে মহিলারা নিজেদের মাথা ও বক্ষাদেশ ঢেকে রাখে। (লিসনুলআরব: ১/১৬২, দারুলহাদিস)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রতিয়মান হয় যে, جلباب বলা হয় ওই কাপড় যা দিয়ে মহিলারা মাথা  ও বক্ষাদেশ ঢেকে রাখে ।


সাহাবায়ে কেরামের ব্যাখা ও আমল

এখন আমারা দেখব যে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম রা. এই আয়াতের কি ব্যাখ্যা করেছেন এবং তারা এর ওপর কিভাবে আমল করেছেন। 


(এক.)

قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَلْحَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَمَرَ اللَّهُ نِسَاءَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا خَرَجْنَ مِنْ بُيُوتِهِنَّ فِي حَاجَةٍ أَنْ يُغَطِّينَ

وُجُوهَهُنَّ مِنْ فَوْقِ رُؤُوسِهِنَّ بِالْجَلَابِيبِ وَيُبْدِينَ عَيْنًا وَاحِدَةً  


আলি ইবনে আবু তালহা হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলিম মহিলাদের এই নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যখন বিশেষ কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথায় কাপড় দিয়ে তাদের চেহারা ঢেকে বের হয় এবং (পথ চলার জন্য) এক চোখ খোলা রাখে।

(দুই.)

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন রহ. বলেন, 


سَأَلْتُ عَبِيدَةَ السَّلْمَانِيَّ عَنْ قول الله عز وجل: يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ فَغَطَّى وَجْهَهُ وَرَأْسَهُ وَأَبْرَزَ عَيْنَهُ الْيُسْرَى 

অর্থ: আমি আবিদা সালমানিকে এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি (আমাকে বুঝানোর জন্য) তার চেহারা এবং মাথা ঢেকে দিলেন এবং বাম চোখ খোলা রাখলেন।


(তিন.)

হযরত ইকরামা রহ. বলেন,


 تُغَطِّي ثُغْرَةَ نَحْرِهَا بِجِلْبَابِهَا تُدْنِيهِ عَلَيْهَا 

অর্থ: মহিলারা মাথার কাপড় দিয়ে তাদের গলার নিচ পর্যন্ত ঢেকে রাখবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির-৬/৫০৩, রুহুল মা‘আনি-২২/৩৫৫ দারুলহাদিস) 


(চার.)

আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. ইফকের দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করে বলেন,


 فَبَيْنَا أَنَا جَالِسَةٌ فِي مَنْزِلِي غَلَبَتْنِي عَيْنِي فَنِمْتُ وَكَانَ صَفْوَانُ بْنُ الْمُعَطَّلِ السُّلَمِيُّ ثُمَّ الذَّكْوَانِيُّ مِنْ وَرَاءِ الْجَيْشِ فَأَدْلَجَ فَأَصْبَحَ عِنْدَ مَنْزِلِي فَرَأَى سَوَادَ إِنْسَانٍ نَائِمٍ فَأَتَانِي فَعَرَفَنِي حِينَ رَآنِي وَكَانَ رَآنِي قَبْلَ الْحِجَابِ فَاسْتَيْقَظْتُ بِاسْتِرْجَاعِهِ حِينَ عَرَفَنِي فَخَمَّرْتُ وَجْهِي بِجِلْبَابِي وَ وَاللَّهِ مَا كَلَّمَنِي كَلِمَةً وَلَا سَمِعْتُ مِنْهُ كَلِمَةً غَيْرَ اسْتِرْجَاعِهِ 

অর্থ: আমি আমার জায়গায় বসা ছিলাম। এক সময় আমার চোখ দুটি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং আমি ঘুমিয়ে গেলাম। সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আস সুলামি জাকওয়ানি ছিল বাহিনীর পিছনে গমনকারী। সে যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌঁছল তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেল। এরপর সে আমার নিকট এসে আমাকে চিনে ফেলল। কারণ পর্দা অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে সে আমাকে দেখেছিল। সে তখন ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলে উঠল,যার দরুন আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি। আল্লাহর কসম আমি তার সাথে কোনো কথা বলিনি এবং ‘ইন্নালিল্লাহি’ বলা ছাড়া তার আর কোনো শব্দও আমি শুনিনি। অন্য রেওয়ায়েতে আছে আমি নিজেকে আবৃত করে ফেলি। (সহিহুল বুখারি-হাদিস নং ৪৭৫০, মাকতাবা শামেলা, সুনানুত তিরমিজি হাদিস নং-৩১৭৯) 

 


(পাঁচ.)

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. বলেন,


كنا مع النبي صلى الله عليه و سلم ونحن محرمون. فإذا لقينا الراكب أسدلنا ثيابنا من فوق رءوسنا. فإذا جاوزنا رفعناها  

অথাৎ আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে এহরাম অবস্থায় ছিলাম। তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তার যখন আমাদের সমানাসামনি চলে আসতো তখন আমরা সকলেই চেহারার ওপর উড়না টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে তা আবার সরিয়ে ফেলতাম। (ইবনেমাজাহ্ হাদিস নং-২৯৩৫, দারাকুতনি হাদিস নং-২৭৯৫ মাকতাবা শামেলা)


(ছয়.)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন,


قام رجل فقال يا رسول الله ماذا تأمرنا أن نلبس من الثياب في الإحرام ؟ فقال النبي صلى الله عليه و سلم: ৃৃৃ.. ولا تنتقب المرأة المحرمة ولا تلبس القفازين 

অর্থাৎ জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল এহরাম অবস্থায় আমরা কোন্ ধরনের পোশাক পরিধান করব? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. এহরাম অবস্থায় নারী-পুরুষের পোশাক কী হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এরপর  তিনি বলেন, এহরাম পরিহিতা নারী  নেকাব পরবে না এবং হাত মোজাও পরবে না। 


(সাত.)

আল্লামা আবু বকর জাস্সাস রহ. (মৃত্যু: ৩৭০ হি.) তাঁর বিখ্যাত অমর গ্রন্থ ‘আহকামুল কুরআন’-এ উল্লেখ করেন, 


في هذه الآية دلالة على أن المرأة الشابة مأمورة بستر وجهها عن الأجنبيينৃৃ. . وفيها دلالة على أن الأمة ليس عليها ستر وجهها وشعرهاৃৃৃ  فجعل الستر فرقا يعرف به الحرائر من الإماء وقد روي عن عمر أنه كان يضرب الإماء ويقول: اكشفن رءوسكن ولا تشبهن بالحرائر.

অর্থাৎ, এ আয়াতে এই নির্দেশনা রয়েছে যে, স্বধীন যুবতি মহিলারা গায়ের মাহরাম পুরুষের সামনে নিজেদের চেহারা ঢেকে রাখার ব্যাপারে আদিষ্ট। ..... এবং এতে এই নির্দেশনাও রয়েছে যে, দাসি মহিলার জন্য চেহারা এবং চুল ঢেকে রাখা আবশ্যক নয়।.................  সুতরাং চেহারা ঢেকে রাখা না রাখাকে স্বাধীন বা দাসি নারী চেনার মানদ- হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বর্ণিত আছে, হযরত ওমর রা. দাসিদের (মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখতে দেখলে) প্রহার করে বলতেন, অ্যাই! তোমরা তোমাদের মাথা খুলে রাখ, স্বাধীন নারীদের সাদৃশ্য গ্রহন করো না। (আহকামুল কুরআন ৩/৪৮৬ দারুলকুতুব আল্ ইলমিয়া)   


পর্যালোচনা:

উপরোক্ত আয়াত, جلباب শব্দের আভিধানিক অর্থ, আয়াতের ব্যাখ্যায় সাহাবা এবং তাবেয়িদের বর্ণনা এবং আম্মাজান হযরত আয়েশা রা.-এর হাদিস থেকে একথাই প্রমানিত হয় যে, মহিলাদের চেহারাও হিজাবের অন্তর্ভূক্ত। গায়ের মাহরামের সামনে তা খোলা রাখা যাবে না।

( দুই)

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ 

অর্থ: তোমরা তাঁদের (নবিপত্নীদের) কাছে  কোনো কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের এবং তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্রতার মাধ্যম। ( সুরা আহযাব, আয়াত: ৫৩) 


আল্লামা হাফেজ ইবনে কাসির রহ. এই আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করেন,‘ নবিগৃহে বিনাঅনুমতিতে প্রবেশে যেমনিভাবে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে; অনুরূপভাবে তোমাদের এই আদেশও দেয়া হচ্ছে যে, কখনো তাদের দিকে তাকাবে না। আর যদি তাদের নিকট তোমাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তা পর্দার আড়াল থেকে চাবে।

এই আয়াত থেকেও বুঝা যায় মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভূক্ত। কেননা যেখানে সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ করে নবিপতিœদের দিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে; একান্ত প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকে প্রয়োজন পুরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এটাকেই পবিত্রতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ইসলামের এই ক্রন্তিকালে “মহিলাদের চেহারা হিজাবের অন্তর্ভূক্ত নয়” অথবা “তাদের  চেহারা ঢেকে রাখা আবশ্যক নয়”-এজাতীয় কথা বড়ই হাস্যকর ও দুঃখজনক। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। 


(তিন)


وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ 

অর্থ:  (হে নবি!) মুমিন নরীদের বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জস্থান হেফাজত করে। আর সাধারণত যা প্রকাশ পেয়ে যায় তা ছাড়া নিজেদের  সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তাদের মাথার ওড়না বক্ষাদেশে ফেলে রাখে। (সুরা নুর আয়াত: ৩১) 

এই আয়াতে ‘যিনত’ প্রদর্শন না করতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। অধিকাংশ তাফসিরবিদ ‘যিনত’ শব্দের অর্থ নিয়েছেন সাজ-সজ্জার স্থান। অর্থাৎ যেসকল অঙ্গে সাজ-সজ্জার অলংকার পরিধান করা হয়। (রুহুল মাআনি: ১৮/৪৪৯ দারুল হাদিস) তাহলে আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সাজ-সজ্জার অঙ্গসমূহ প্রদর্শন না করা মহিলাদের জন্য ওয়াজিব (মারেফুল কোরআন: ৬/৪০১-মাকতাবা ইসলামিয়া ঢাকা) 


আয়াতের এই অংশ থেকেও মহিলাদের চেহারা হিজাবের অন্তর্ভূক্ত হওয়া এবং পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখার অপরিহার্যতা অনুধাবন করা যায়।  


একান্ত প্রয়োজনে চেহারা খোলা

সুরা নুরের এই আয়াতে চেহারার পর্দার ব্যাপারে কিছুটা ব্যতিক্রম বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ব্যতিক্রমটা হচ্ছে,  إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا  বাক্যটি। আয়াতের প্রথমাংশে বলা হয়েছে নারীদের সাজ-সজ্জার কোনো অঙ্গ পরপুরুষের সামনে প্রদর্শন করা বৈধ নয়; অবশ্য যেসব অঙ্গ যেগুলো কাজকর্ম ও চলা-ফেরার সময় আপনা আপনি প্রদর্শিত হয়ে যায় সেগুলো পূর্বোক্ত বিধানের ব্যতিক্রম। প্রয়োজনের তাগিদে এগুলো প্রদর্শন করার মধ্যে কোনো গুনাহ নেই। (ইবনে কাসির ৬/৫০ দারুলহাদিস, মারেফুল কুরআন: ৬/৪০১ মাকতাবা ইসলামিয়া ঢাকা) 


مَا ظَهَرَ مِنْهَا -দ্বারা উদ্দেশ্য কী?

مَا ظَهَرَ مِنْهَا দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর মতে সেগুলো হলো, كالرداء والثياب বোরকা, লম্বা চাদর ইত্যাদি। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায়, যে প্রয়োজনবশত বাইরে যাওয়ার সময় যেসব ওপরের কাপড় আবৃত করা সম্ভব নয় সেগুলো ব্যতিত সাজ-সজ্জার কোনো বস্তু প্রদর্শন করা জায়েয নয়। 


কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর মতে  مَا ظَهَرَ مِنْهَا দ্বারা وجهها وكفيها والخاتم মুখমণ্ডল ও হাতের তালু এবং আংটি বুঝানো হয়েছে। কেননা নারী প্রয়োজনবশত বাইরে যেতে বাধ্য হলে কিংবা চলাফেরা ও লেনদেনের সময় মুখম-ল ও হাতের তালু আবৃত রাখা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে। অতএব হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর ব্যাখ্যা অনুসারে প্রয়োজনে পরপুরুষের সামনে চেহারা ও হাতের তালু খোলা রাখার অবকাশ আছে। (প্রাগুক্ত) 


ইমাম বায়যাবি ও খাজেন রহ. এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, নারীর আসল বিধান এই যে সে তার সাজ-সজ্জার কোনো কিছুই প্রদর্শন করবে না, আয়াতের উদ্দেশ্যও তাই মনে হয়। তবে চলাফেরা ও কাজকর্মে স্বভাবত যেগুলো খুলে যায় সেগুলো প্রদর্শন করতে পারবে। বোরকা, চাদর, চেহারা, ও হাতের তালু এগুলোর অন্তর্ভূক্ত। নারী কোনো প্রয়োজনে বাইরে বের হলে বোরকা, চাদর ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়ে যাওয়াটা সুনির্দিষ্টি। লেনদের প্রয়োজনে কখনো কখনো চেহারা এবং হাতের তালু প্রদর্শিতা হয়ে পড়ে। এটাও ক্ষমারযোগ্য; গুনাহ নয়। (মারেফুল কুরআন: ৬/৪০২ মাকতাবা ইসলামিয়া ঢাকা)

 

ইমাম বায়যাবি রহ. উল্লেখ করেন,

والمستثنى هو الوجه والكفان لأنها ليست بعورة والأظهر أن هذا في الصلاة لا في النظر فإن كل بدن الحرة عورة لا يحل لغير الزوج والمحرم النظر إلى شيء منها إلا لضرورة كالمعالجة وتَحَمُّلِ الشهادة

অর্থাৎ সৌন্দর্য প্রদর্শনের বিধান থেকে চেহারা এবং দুই হাতের তালুর বিধান সতন্ত্র। কেননা এগুলো সতর নয়। তবে সুস্পষ্ট কথা হচ্ছে এটা নামাযের  ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নামাযের বাইরে তাকানোর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। বরং স্বাধীন নারীর পুরো শরীরই সতর; পরপুরুষের জন্য তার শরীরের দিকে তাকানো জায়েয নাই। তবে একান্ত বাধ্যবাধকতা যদি হয়, যেমন চিকিৎসা অথবা সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে তাহলে তার অবকাশ আছে। (তাফসিরে বায়যাবি: ৪/৩৭৭ মাকতাবা শমেলা) 


তাফসিরে রুহুল মাআনিতে আল্লামা আলুসি রহ. যাওয়াজের নামক কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে  إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا- এর ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন,   


ويكون المعنى أن ما ظهر منها من غير إظهار كان كشفته الريح مثلا فهن غير مؤاخذات به في دار الجزاء ، وفي حكم ذلك ما لزم إظهاره لنحو تحمل شهادة ومعالجة طبيب


অর্থাৎ مَا ظَهَرَ مِنْهَا -এর অর্থ হলো,শরীরের যেসকল অঙ্গ প্রদর্শন করা ছাড়াই আপনা আপনি প্রদর্শিত হয়ে যায়, যেমন বাতাসের কারণে কাপড় সরে যাওয়া ইত্যাদি, সেক্ষেত্রে তাকে আখেরাতে জিজ্ঞাসা করা হবে না। আদালতে সাক্ষ্য প্রদান, চিকিৎসা গ্রহন ইত্যাদিও এই বিধানের আওতাভূক্ত। (রুহুল মাআনি: ১৮/৪৫১ দারুলহাদিস) 


হাদিসের আলোকে চেহারার পর্দা

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বস রা বর্ণনা করে বলেন,

قال المرأة عورة فإذا خرجت استشرفها الشيطان

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সা.-এর এরশাদ করেন, মহিলারা হচ্ছে অরক্ষিত সম্পদ। তারা যখন বাইরে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। (সুনান আত তিরমিজি: হাদিস নং ১১৭৩)


হযরত আবু হোরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন,

فزنا العين النظر وزنا اللسان المنطق والنفس تمنى وتشتهي والفرج يصدق ذلك أو يكذبه

অর্থ: চোখের জিনা হলো দৃষ্টি দেয়া। মুখের জিনা হলো, কথা বলা। হৃদয় কামনা করে আর লজ্জাস্থান তা গ্রহন করে বা প্রত্যাখ্যান করে। (সহিহুল বুখারি হাদিস নং: ৬৬১২)


হযরত জরির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন,

سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ نَظَرِ الْفُجَاءَةِ فَأَمَرَنِى أَنْ أَصْرِفَ بَصَرِى  

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে অকষ্মিক দৃষ্টির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে আদেশ দিলেন যেন আমি আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখি। (সহিহুল মুসলিম হাদিস নং: ২১৫৯, মুসনাদ আহমাদ হাদিস নং ১৯১৬০ শামেলা ভার্সন)


রাসূলুল্লাহ সা. হযরত আলি রা.-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

"يا على لا تتبع النظرة النظرة ، فإن لك الاولى وليست لك الآخرة  

অর্থ: হে আলি একবার দৃষ্টির পর তুমি দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিও না। কেননা প্রথম দৃষ্টি তোমর জন্য ক্ষমাযোগ্য কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টি ক্ষমারযোগ্য নয়। (আবুদাউদ: হাদিস নং ২১৪৯ আহমাদ: হাদিস নং ২২৯৯১) 


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করে বলেন,

أردف رسول الله صلى الله عليه و سلم الفضل بن عباس يوم النحر خلفه على عجز راحلته وكان الفضل رجلا وضيئا فوقف النبي صلى الله عليه و سلم للناس يفتيهم وأقبلت امرأة من خثعم وضيئة تستفتي رسول الله صلى الله عليه و سلم فطفق الفضل ينظر إليها وأعجبه حسنها فالتفت النبي صلى الله عليه و سلم والفضل ينظر إليها فأخلف بيده فأخذ بذقن الفضل فعدل وجهه عن النظر إليها

অর্থ: বিদায় হজের দিন রাসূলুল্লাহ সা.ফজল ইবনে আব্বাসকে নিজের বাহনের পিছনে বসিয়েছিলেন। ফজল ছিলেন অত্যন্ত উজ্জল বর্ণের। রাসূলুল্লাহ সা. দাঁড়িয়ে  লোকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। অগত্য খাসআম গোত্রের একজন সুন্দরী মহিলা এসে রাসূলুল্লাহ সা.-কে মাসয়ালা জিজ্ঞেস করল। (পিছন থেকে) ফজল তার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তার সৌন্দর্য্যে তিনি বিমুগ্ধ হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সা. ফজলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি মহিলার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সা. পিছনে হাত ঘুরিয়ে তার থুতনিতে ধরে মহিলার দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে  দিলেন। (সহিহুল বুখারি: হাদিস নং ৬২২৮)


ফোকাহায়ে  কেরামগণের অভিমত

মালেকি মাজহাব:- মুফতি আযম পাকিস্তান, আল্লাম মুফতি মুহাম্মাদ শফি রহ. তাফসিরে মালেফুল কুরআনে উল্লেখ করেন ইমাম মালেক রহ.-এর প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, শরিয়তসম্মত কোনো ওজর ছাড়া পরনারীর (গায়ের মারহাম মহিলা)  চেহারা ও হাতের তালুর দিকে দৃষ্টি দেয়া নাজায়েয। 


শাফেয়ী মাজহাব:- যাওয়াজের কিতাবে আল্লাম ইবনে হাজার মক্কি রহ. ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর মত উল্লেখ করেছেন যে; মহিলাদের চেহারা ও হাতের তালু যদিও সতরের অন্তর্ভূক্ত নয়, ফলে সেগুলো খোলা রেখে নামাজ পড়লে নামাজ সহীহ হয়ে যাবে তথাপিও গায়ের মাহরাম পুরুষের জন্য শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড় তার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া জায়েয নাই। (প্রাগুক্ত)


হাম্বলী মাজহাব:- ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. হযরত ইবনে মাসউদ রা.-এর মত গ্রহন করে  إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا  দ্বারা শুধুমাত্র কাপড় উদ্দেশ্য নিয়েছেন। (রুহুল মাআনি: ১৮/৪৫১ দারুলহাদিস) 


হানাফি মাজহাব

হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ফাতোয়াগ্রন্থ রদ্দুল মুহতার (যা সর্বমহলে ফতোয়া শামি নামে পরিচিত) ও তার মূলগ্রন্থ আদ্দুররুল মুহতারে এব্যাপারে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। নি¤েœ সেখান থেকে দুইটি উদ্ধৃতি পেশ করা হলো। 

এক.

(وتمنع) المرأة الشابة (من كشف الوجه بين الرجال) لا لانه عورة بل (لخوف الفتنة) كمسه وإن أمن الشهوة لانه أغلظ، ولذا ثبت به حرمة المصاهرة ৃ.ৃৃ. (ولا يجوز النظر إليه بشهوة  ৃ.ৃৃ


অর্থাৎ যুবতী মহিলাকে পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখতে বারণ করা হবে। এটা এজন্য নয় যে তা পর্দার অন্তর্ভূক্ত। বরং তা ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার স্বার্থে। যেমনিভাবে তাকে স্পর্শ করা নিষেধ যদিও যৌনচাহিদার অশঙ্কা মুক্ত হোক না কেন। একারণেই দৃষ্টির মাধ্যমে হুরমতে মুসাহারা (বৈবাহিকসূত্র সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ বিধান) সাবস্ত হয়। আর তার প্রতি যৌনচাহিদা নিয়ে তাকানোও জায়েজ নাই। 


আল্লামা ইবনে আবিদিন শামি রহ. এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেন, 

وَالْمَعْنَى تُمْنَعُ مِنْ الْكَشْفِ لِخَوْفِ أَنْ يَرَى الرِّجَالُ وَجْهَهَا فَتَقَعُ الْفِتْنَةُ لِأَنَّهُ مَعَ الْكَشْفِ قَدْ يَقَعُ النَّظَرُ إلَيْهَا بِشَهْوَةٍ .......... كَمَا يُمْنَعُ الرَّجُلُ مِنْ مَسِّ وَجْهِهَا وَكَفِّهَا وَإِنْ أَمِنَ الشَّهْوَةَ ........ إلَّا لِحَاجَةٍ كَقَاضٍ أَوْ شَاهِدٍ بِحُكْمٍ أَوْ يَشْهَدُ عَلَيْهَا ...... وَكَخَاطِبٍ يُرِيدُ نِكَاحَهَا فَيَنْظُرُ وَلَوْ عَنْ شَهْوَةٍ بِنِيَّةِ السُّنَّةِ لَا قَضَاءِ الشَّهْوَةِ، ...... أَوْ مُدَاوَاتِهَا إلَى مَوْضِعِ الْمَرَضِ بِقَدْرِ الضَّرُورَةِ ....الخ

পরপুরুষের সামনে চেহারা প্রদর্শন করতে মহিলাদের বারণ করা হবে। কেননা হতে পারে এর কারণে ফেতনা সৃষ্টি হবে। কারণ অনেক সময় পরনারীর প্রতি দৃষ্টি যৌনচাহিদার কারণেই হয়ে থাকে।........ যেমনিভাবে  পরপুরুষকে পরনারীর চেহার বা হাতের তালু স্পর্শ করতে বারণ করা হবে। যদিও তা যৌনচাহিদা মুক্ত হোক না কেন।.......আল্লামা শামি রহ. আরো উল্লেখ করেন,‘তবে একান্ত প্রয়োজন হলে তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাবে। যেমন বিচারক কিংবা  সাক্ষীর ক্ষেত্রে সাক্ষ্য প্রদানের সময়। অনুরূপভাবে যদি কেউ কোনো নারীকে বিবাহের উদ্দেশ্যে দেখতে চায় তাহলেও তার চেহারা দেখতে পারবে।....... এমনিভাবে চিকিৎসার উদ্দেশ্যেও শারীরের প্রয়োজনীয় অংশ দেখতে পারবে। (আদ্দুররুল মুখতার: রদ্দুল মুতার সম্বলিত,২/৯৮ মাকতাবা রশিদিয়া-পাকিস্তান) 


দুই


(و) ينظر (من الاجنبية) ولو كافرة. مجتبى (إلى وجهها وكفيها فقط) للضرورة ৃ.  (فإن خاف الشهوة) أو شك (امتنع نظره إلى وجهها) فحل النظر مقيد بعدم الشهوة وإلا فحرام، وهذا في زمانهم، وأما في زماننا فمنع من الشابة ৃ. (إلا) ৃ (لحاجة) كقاض وشاهد يحكم (ويشهد عليهاৃ. (وكذا مريد نكاحها) ولو عن شهوة بنية السنة لا قضاء الشهوة (وشرائها ومداواتها ينظر) الطبيب (إلى موضع مرضها بقدر الضرورة) إذ الضرورات تتقدر بقدرها


এই আররি পাঠে আল্লামা হাসকাফি রহ. (তারবিরুল আবসারের আরবি পাঠসহ) হানাফি মাজহাবের বর্ণনা এভাবে দিচ্ছেন যে, পরনারীর চেহারা দেখার অবকাশের বিষয়টি যদিও যৌনচাহিদা না থাকার ওপর মওকুফ ছিল; কিন্তু বর্তমান সময়ে তা প্রযোজ্য নয়। কেননা বর্তমান সময় হচ্ছে ফেতনার সময়। কাজেই পরনারীর চেহারা দেখা না দেখা বতর্মানে শুধুমাত্র প্রয়োজনের ওপর মওকুফ থাকবে। অর্থাৎ একান্ত প্রয়োজন হলেই কেবল পরনারীর চেহারা দেখা যাবে অন্যথায় দেখা যাবে না। (প্রাগুক্ত:৯/৬১০) 


উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বিন, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব, সাবেক বিচারপতি আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহু “সময়ের পরিবর্তনে আহকামের পরিবর্তন” এই শিরোনামে الحاجة -এর আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন,“এর দৃষ্টান্ত হলো মহিলার মুখমণ্ডল খোলা রাখার ন্যায়। প্রকৃত বিধান হচ্ছে মহিলার চেহারা খোলা রাখা বৈধ নয়। কোনো কোনো ফকিহ এটাকে বৈধ বলেছেন। তবে বৈধতার দিকটি যদিও অপ্রণিধানযোগ্য; কিন্তু একান্ত প্রয়োজনে বিপরিত দিকটাকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে। একারনেই হানাফি ফোকাহয়ে কেরাম সাক্ষ্য প্রদান এবং হজের সফরে প্রচ- ভীড়ের সময় যখন চেহারা খোলা না রাখলে পথ চলা দুস্কর হয়ে পড়ে-এমন ক্ষেত্রে চেহারা খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছেন। (উসুলুল ইফতা: পৃষ্ঠা-২৭১) 


বাস্তবতার নিরিখে চেহারার পর্দার যৌক্তিকতা: স্কুল কলেজেও চেহারা ঢেকে রাখুন

উপরোক্ত মাজহাবগুলোর বর্ণনা থেকে এটাই বুঝে আসে যে, রাস্তা-ঘাট, আফিস-আদালত বা স্কুল কলেজেও মহিলারা চেহারা ঢেকে রাখবে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া চেহারা উন্মুক্ত করবে না। আর নিজেদের বাসা-বাড়িতে যদি কোনো গায়রে মাহরাম পুরুষ থাকে না, কাজেই সেখানে চেহারা ঢেকে রাখার প্রয়োজন নাই। 


চিকিৎসার ক্ষেত্রে পর্দার বিধান

চিকিৎসার জন্য মহিলা ডাক্তার পাওয়া না গেলে পুরুষ ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা কারানোর আবকাশ আছে। সেক্ষেত্রে যদি মহিলার শরীর দেখার প্রয়োজন হয় তাহলে পর্দা লঙ্ঘন করে হলেও চিকিৎসা করানো বৈধ। তবে সর্তক থাকতে হবে যেন একান্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত অঙ্গ প্রদর্শিত না  হয়।  প্রয়োজনাতিরিক্ত অঙ্গ  দেখা জায়েজ নাই, তা হারাম


হানাফি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ও সর্বজনস্বীকৃত ফিকহি মূলনীতি বিষয়ক কিতাব, আল আশবাহ ওয়ান নাজায়েরে-এর “প্রয়োজনের তাগিদে যা বৈধ তা প্রয়োজন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে”-এই শিরোনামে উল্লেখ আছে,

والطبيب إنما ينظر من العورة بقدر الحاجة

অর্থাৎ ডাক্তার প্রয়োজন অনুপাতে সতর দেখতে পারবে। (আল আশবাহ ওয়ান নাজায়ের পৃষ্ঠা: ) 


আল জাওহারাতুন নাইয়্যেরাহ নামক কিতাবের --/--পৃষ্ঠায় এবং ফতোয়া শামির --পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

( ويجوز للطبيب أن ينظر إلى موضع المرض منها ) أما إذا كان المرض في سائر بدنها غير الفرج فإنه يجوز له النظر إليه عند الدواء ؛ لأنه موضع ضرورة وإن كان في موضع الفرج فينبغي أن يعلم امرأة تداويها فإن لم توجد امرأة تداويها وخافوا عليها أن تهلك أو يصبيها بلاء أو وجع لا يحتمل ستروا منها كل شيء إلا الموضع الذي فيه العلة ثم يداويها الرجل ويغض بصره ما استطاع إلا من موضع الجرح ..... وقال ابن عابدين: والظاهر أن " ينبغي " هنا للوجوب


অর্থাৎ ডাক্তারের জন্য রোগাক্রান্ত স্থান দেখা জায়েজ আছে। আর যদি মহিলার লজ্জাস্থান ব্যতিত পুরো শরীর আক্রান্ত থাকে তাহলে চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তার তার দিকে তাকাতে পারবে। কেননা এটা প্রয়োজনের ক্ষেত্র। আর যদি খোদ লজ্জাস্থানই আক্রান্ত হয়, তাহলে কোনো মহিলাকে চিকিৎসা শিখেয়ে তাকে দিয়ে চিকিৎসা করাবে। তবে হ্যাঁ, যদি চিকিৎসায় সক্ষম এমন কোনো মহিলা পাওয়া না যায় এবং রুগীর মৃত্যুর আশঙ্কা হয় কিংবা রোগ বৃদ্ধি পেয়ে তার কষ্ট সহ্যসীমার বাইরে চলে যায় তাহলে তার পুরো শরীর  ঢেকে দিয়ে শুধু রোগাক্রান্ত স্থানটি খোলা রেখে পুরুষ ডাক্তার চিকিৎসা করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রেও আক্রান্ত স্থান ব্যতিত শরীরের অন্য সকল আঙ্গ থেকে চোখ নিচু করে (সরিয়ে) রাখতে হবে। দিবে।


وكذا إذا كان بها جرح أو قرح في موضع لا يحل للرجال النظر إليه فلا بأس أن تداويها إذا علمت المداواة فان لم تعلم تعلم ثم تداويها فان لم توجد أمرأة تعلم المداواة ولا امرأة تتعلم وخيف عليها الهلاك أو بلاء أو وجع لا تحتمله يداويها الرجل لكن لا يكشف منها لا موضع الجرح ويغض بصره ما استطاع لان الحرمات الشرعية جاز أن يسقط اعتبارها شرعا لمكان الضرورة

অনুবাদ: 

 (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২৯৯ যাকারিয়া দেওবন্দ)  


নবিযুগে নারীদের জিহাদের ময়দানে গমন

তথাকথিত প্রগতিশীল নারীবাদীরা, নারী-পুরুষের সহাবস্থান, লিঙ্গবৈষম্য দূরিকরণ, নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার, নারী শক্তি ইত্যদি শ্লোগান তুলে সহশিক্ষা, নারীদের উন্মুক্ত চলাফেরা ও পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে জীবনের সকল পর্যায়ে নারীদের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত করণের পথকে সুগম করতে প্রায়ই নবিযুগে ‘নারীদের জিহাদের ময়দানে গমন করা’কে দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন! এমনকি একধাপ এগিয়ে তাদের কেউ কেউ একথাও বলে বেড়ান যে, সে যুগে নারীরা পুরুষের সাথে লাড়াইয়েও আংশগ্রহন করেছেন! (আল্লাহ আমাদের এজাতীয় কথা থেকে হেফাজত করুন।) বড়ই অবাক লাগে যখন দেখি সমাজের কর্তা ব্যক্তিরাও অন্ধের হাতি ন্যায় ভোল পাল্টিয়ে একথাগুলো বলতে থাকেন। তাদের কান্ড-কারখানা, কথা-বার্তা, এবং দ্বিন-ধর্ম সম্পর্কে হঠকারিতামূলক নিত্য-নতুন ‘আপডেট’ দেখে এবং শোনে লজ্জায় মাথা নুইয়ে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার থাকে না। ভাবতেই গা শিউয়ে উঠে যে, অহর্ণিশি আসলে আমরা কাদের পিছনে দৌড়াচ্ছি!  নিন্মোক্ত আলোচনায় হাদিসের আলোকে আমরা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ! 


নবিযুাগে নারীদের জিহাদের ময়দানে গমনের বিষয়ে মৌলিকভাবে সাতটি হাদিস পাওয়া যায়। সনদ ও বর্ণনাকারীর ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন কিতাবে হাদিসগুলো বহুসংখ্যক সনদে উদ্বৃত হয়েছে।   


এক. হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিস

মুসলিম শরিফে “পুরুষের সাথে মহিলার যুদ্ধে গমন” আধ্যয়ে হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, 

أن أم سليم اتخذت يوم حنين خنجرا فكان معها. فرآها أبو طلحة فقال يا رسول الله!  هذه أم سليم معها خنجر فقال لها رسول الله صلى الله عليه و سلم (ماهذاالخنجر؟) قالت اتخذته إن دنا مني أحد من المشركين بقرت به بطنه فجعل رسول الله صلى الله عليه و سلم يضحك-----  الخ

অর্থাৎ, উম্মে সুলাইম (আনাস রা.-এর মা) হুনাইনের যুদ্ধে একটি খঞ্জর হাতে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলেন। আবু ত্বালহা (উম্মে সুলাইমের স্বামী) তাঁকে দেখে ( কিছুটা শঙ্কিত হয়ে) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ওই দেখেন উম্মে সুলাইমের হাতে খঞ্জর! রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, এই খঞ্জর তুমি কেন নিয়েছ? তিনি বললেন, আমি এটা এজন্য হাতে নিয়েছি, যদি আমার কাছে কোন মুশরিক ধরা পড়ে তাহলে তাহলে এটা দিয়ে আমি তার পেট ফুটা করে দিব। তাঁর উত্তর শোনে রাসূলুল্লাহ হাসতে লাগলেন। (সহিহ মুসলিম: হাদিস ১৮০৯) 


দুই. হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিস 

হজরত আনাস রা. র্দীঘ হাদিস বর্ণনা করে বলেন,

فَيَقُولُ أَبُو طَلْحَةَ ----- وَلَقَدْ رَأَيْتُ عَائِشَةَ بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ وَأُمَّ سُلَيْمٍ وَإِنَّهُمَا لَمُشَمِّرَتَانِ أَرَى خَدَمَ سُوقِهِمَا تُنْقِزَانِ الْقِرَبَ عَلَى مُتُونِهِمَا تُفْرِغَانِهِ فِي أَفْوَاهِ الْقَوْمِ ثُمَّ تَرْجِعَانِ فَتَمْلَآَنِهَا ثُمَّ تَجِيئَانِ فَتُفْرِغَانِهِ فِي أَفْوَاهِ الْقَوْمِ ----الخ 

অর্থাৎ, আবু তালহা বলেন,.....আমি আবু বকরের মেয়ে আয়েশা এবং উম্মে সুলাইমকে কাপড় গুটানো অবস্থায় দেখলাম। আমি তাদের পায়ের নূপুর দেখতে পেলাম। তারা পিঠে মশ্ক নিয়ে দ্রুত হেঁটে চলছেন। আহতদের মুখে পানি দিয়ে পুনরায় ফিরে এসে মশ্ক ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে বারাবার আশা যাওয়া করে তারা আহতদের পানি পান করাচ্ছেন। (সহিহুল বুখারি: হাদিস নং ৩৮১১ ও ৪০৪৬) 


৩. খায়বর যুদ্ধে ছয়জন নারীর অংশগ্রহনের হাদিস

হাশরাজ ইবনে জিয়াদ তার দাদি থেকে বর্ণনা করে বলেন,

أَنَّهَا خَرَجَتْ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي غَزْوَةِ خَيْبَرَ سَادِسَ سِتِّ نِسْوَةٍ، فَبَلَغَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَبَعَثَ إِلَيْنَا فَجِئْنَا فَرَأَيْنَا فِيهِ الْغَضَبَ ، فَقَالَ: ্রمَعَ مَنْ خَرَجْتُنَّ، وَبِإِذْنِ مَنْ خَرَجْتُنَّ؟গ্ধ فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ خَرَجْنَا نَغْزِلُ الشَّعَرَ وَنُعِينُ بِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَمَعَنَا دَوَاءُ الْجَرْحَى، وَنُنَاوِلُ السِّهَامَ وَنَسْقِي السَّوِيقَ. فَقَالَ: ্রقُمْنَগ্ধ  

অর্থাৎ : খায়বর যুদ্ধে তারা ছয়জন মহিলা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে রওয়ানা হয়েছিলেন। এই সংবাদ যখন রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে পৌঁছল তখন তিনি আমাদের তলব করলেন। তখন আমরা এসে তাঁর চোহরায় রাগের ছাপ দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, “তোমরা কার সাথে বের হয়েছ?! কার আনুমতি নিয়ে বের হয়েছ”? তখন আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা গজল পরিবেশন করে আল্লাহর রাস্তায় সাহায্যের উদ্দেশে বের হয়েছি। তাছাড়া আমাদের সাথে মলম আছে। আমরা তীর বহন করব এবং ছাতু গুলিয়ে দিব। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তাহলে থাকো। আবু দাউদ: হাদিস নং ২৮২৯  


চার. রবিঈ বিনতে মুয়াওয়েজর বর্ণিত হাদিস

রবিঈ বিনতে মুয়াওয়েজ বর্ণনা করে বলেন,

كنا نغزو مع النبي صلى الله عليه وسلم فنسقي القوم ونخدمهم ونرد الجرحى والقتلى إلى المدينة/ رقم الحديث:  ২৮৮২+২৮৮৩

রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে আমরা যুদ্ধে গিয়ে মুজাহিদদের পানি পান করাতাম, তাদের খেদমত করতাম এবং আসুস্থ ও শহিদদের মদিনায় নিয়ে আসাতম। (সহিহুল বুখারি: হদিস ২৮৮২ ও ২৮৮৩)


পাঁচ. উম্মে আতিয়্যার বর্ণিত হাদিস 

উম্মে আতিয়া আনসারি রা. বলেন,

غزوت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم سبع غزوات . أخلفهم في رحالهم . وأصنع لهم الطعام . وأداوى الجرحى . وأقوم على المرضى  .

অর্থাৎ, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে সাতটি যুদ্ধে শরিক হয়েছি। আমি তাদের কাফেলার পেছনে পেছনে চলতাম, তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করে দিতাম, আহতদের চিকিৎসা দিতাম এবং অসুস্থদের সেবা শুশ্রূষা করতাম। (ইবনে মাজাহ্ হাদিস নং -২৮৫৬


ছয়. ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হাদিস

নাজদাহ নামক জনৈক ব্যক্তি হজরত ইবনে আব্বাস রা. কে পাঁচটি বিষয়ে  জিজ্ঞেস করল। তন্মধ্যে প্রথম প্রশ্ন ছিল যে রাসূলুল্লাহ সা. কি নারীদে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যেতেন? উত্তরে হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন,

 وَقَدْ كَانَ يَغْزُو بِهِنَّ فَيُدَاوِينَ الْجَرْحَى

অর্থাৎ, তিনি নারীদের সাথে নিয়ে যেতেন। তারা আহতদের চিকিৎসা করত। (মুসলিম হাদিস নং ১৮১২)


সাত. আনাস রা. বর্ণিত হাদিস

আনাস রা. বর্ণনা করে বলেন,


كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يغزو بام سليم ونسوة من الأنصار ليسقين الماء ويداوين الجرحى: رقم الحديث-

 অর্থাৎ, পানি পান করানো এবং আহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সা. উম্মে সুলাইম এবং কয়েকজন আনসারি মহিলাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। (আবু দাউদ: হাদিস ২৫৩১,তিরমজি: হাদিস নং ১৫৭৫ “যুদ্ধের ময়দানে নারীদের গমন” অধ্যায়)


মাতৃভাষা জানেন এমন যেকোন মানুষই ওপরে বর্ণিত হাদিসগুলোর সরল অনুবাদের প্রতি লক্ষ্য করলে নারী সাহাবিদের যুদ্ধের ময়দানে গমন করার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে পারবেন। কেননা প্রতিটি হাদিসে বর্ণনাকারীগণ নিজেরাই তাদের গমনের উদ্দেশ্য উল্লেখ করে দিয়েছেন। তারপরেও পাঠকের সদয়দৃষ্টির নিমিত্তে আমরা কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করছি। 


১. ওপরে বর্ণিত প্রথম হাদিসে দেখা যাচ্ছে, সাহাবি আবু তালহা তাঁর স্ত্রীর হাতে খঞ্জর দেখতে পেয়ে যেন শঙ্কিত হয়ে পড়লেন, বিধায় তিনি বিষয়টির প্রতি রাসূলুল্লাহ সা.-এর দৃষ্টি আর্কষণ করেছেন। সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সা.-ও যেন কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেলেন। তাই তাঁকে তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করে বসলেন। কেননা নারীদের তো হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার জন্য ময়দানে আনা হয়নি! কিন্তু তিনি যখন খঞ্জর হাতে নেয়ার বিষয়টি রাসূলের সামনে স্পষ্ট করে দিলেন তখন রাসূল সা. তাকে আপন আবস্থায় ছেড়ে দিলেন। 


২. দ্বিতীয় হাদিসে আবু তালহা রা. কথা-“তারা পিঠে মশ্ক নিয়ে দ্রুত হেঁটে চলছেন। আহতদের মুখে পানি দিয়ে পুনরায় ফিরে এসে মশ্ক ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে বারাবার আশা যাওয়া করে তারা আহতদের পানি পান করাচ্ছেন”-দ্বারা রণাঙ্গনে নারীদের কাজের ধরনটি একেবারে দিবালোকের ন্যায় ফুটে উঠেছে।  

প্রসঙ্গত, কারো মনে খটকা লাগতে পারে যে, আবু ত্বালহা রণাঙ্গণে নারীদের দেখলেন কী করে! তবে কি সেক্ষেত্রে পর্দার বিষয়টি শিথিলযোগ্য? যেন এই খটকার আপনোদন করতেই ইমাম নববি রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন , 

هذا كان يوم أحد قبل أمر النساء بالحجاب وتحريم النظر إليهن ولأنه لم يذكر هنا أنه تعمد النظر إلى نفس الساق فهو محمول على أنه حصلت تلك النظرة فجأة بغير قصد ولم يستدمها----  وفي هذا الحديث اختلاط النساء في الغزو برجالهن في حال القتال لسقي الماء ونحوه 

অর্থাৎ, এটা ছিল উহুদের যুদ্ধের দিনে, মহিলাদের পর্দার আদেশ দেয়ার এবং তাদের দিকে তাকানো হারাম হওয়ার আগেকরার কথা। কেননা এখানে এই কথার উল্লেখ নেই, যে তিনি (আবু ত্বালহা) তাদের পায়ের দিকেই তাকানোর ইচ্ছা করেছিলেন! ধরে নেয়া হবে যে সেই দৃষ্টিটা তাঁর থেকে আকস্মিক ভাবেই হয়েছে এবং তিনি দৃষ্টি দীর্ঘায়িতও করেননি! (শরহুন নববি, মুসলিম শরিফ সম্বলিত: ২/১১৬ হিন্দুস্তানি অ্যাডিশন)


৩. রসূলুল্লাহ সা.-এর দৃষ্টিতে নারীদের জন্য রণাঙ্গনে গমন যে কতটা অপছন্দনীয় তৃতীয় হাদিসে সেটাই ফুটে উঠেছে। যার কারণেই তিনি খায়বরে গমনেচ্ছুক নারীদের ডেকে রাগতস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কা-র সাথে বের হয়েছ?! কা-র আনুমতি নিয়ে বের হয়েছ”?! কিন্তু পরবর্তী তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানতে পেরে তাদের অনুমতি দিয়েছেন। 


চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম হাদিসেও বর্ণনাকারীগণ নিজেরাই তাদের গমনের উদ্দেশ্য উল্লেখ করে দিয়েছেন। সবগুলো হাদিসেই তারা একথা বলেছেন যে তারা  মূলত মুজাহিদ বাহিনীর সহযোগিতা, প্রেরণা যোগানো এবং আহত ও শহিদ মুজাহিদের সেবা-শুশ্রƒষার জন্যই যুদ্ধে যেতেন।  

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. রবিঈ বিনতে মুয়াওয়েজের হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, “নারীরাও  লড়াইয়ে অংশগ্রহন করেছেন” এই মর্মে আমি কোন উল্লেখ পাইনি। (ফতহুল বারী-৬/৯০  দারুল হাদিস) উপরন্তু ২৮৮২ নং হাদিসের ব্যাখা করতে গিয়ে হাফেজ রহ. আরো বলেন, ইসমাঈলী খালেদ ইবনে জাকওয়ানের রেওয়ায়েতে ولا نقاتل (আমরা লড়াই করাতাম না) শব্দ বৃদ্ধি করেছেন। (ফতহুলবারি ৬/৯২)  

এর থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রনাঙ্গনে অংশগ্রহনের জন্য নারীদের ময়দানে নেয়া হতো না, কিংবা তারাও রণাঙ্গনে লড়াইয়ে অংশগ্রহনের উদ্দেশ্যে বের হতেন না। কাজেই এই ঘটনাগুলোকে দলিল হিসেবে পেশ করতে চাওয়া মূর্খতা বৈকি!! 


আম্মাজান খাদিজা রা.-ও ব্যবসায়ী ছিলেন, নারীরাও যুদ্ধে অংশগ্রহন করতেন 

গতকাল (১২/১০/১৯ই) শনিবার রজধানী ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে নারী উন্নয়নের ‘বয়ান’ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “প্রথম ইসলামগ্রহনকারী নারী হজরত খাদিজা রা. ব্যবসা করতেন। ব্যবসার উদ্দেশ্যে তিনি উটের পিঠে চড়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াতেন।” এজাতীয় তত্ত্ব ও তথ্য তিনি প্রায়ই টেনে থাকেন। আবার নারিদের যুদ্ধে অংশগ্রহনের বিষয়টিও প্রায়ই তাঁর আলোচনায় স্থান পায়! 


একজন মা‘ও কি ব্যবসায়ী হতে পারলেন না?

রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্ত্রীগণ এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ নারী। উম্মাহর জননী। কুরআন তাদেরকে এই মর্যাদা দিয়েছে। বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা এবং সুনিপুণ যোগ্যতায় পৃথিবীর অন্য সকল নারীর তুলনায় তারা অনন্য। কুরআনের বহু আয়াতে তাঁদেরকে প্রত্যোক্ষ সম্বোধন করে বিধান নাজিল করে পরোক্ষভাবে আল্লাহ তায়ালা জগতের সকল নারীকে তাঁদের অনুসরণ করতে আদেশ দিয়েছেন। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকরি-বাকরি, আবাস-প্রবাস ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই উম্মাহজননীগণ নারীদের জন্য সর্বোত্তম নমুনা। নবি সা.-কে বহু বিবাহে অবকাশ প্রদানের একটি প্রাকৃতিক সিদ্ধান্ত এটাও ছিলো, তাঁদের মাধ্যমে উম্মাহর নারীদের  শরিয়াতের বিধিবিধান শিক্ষা প্রদান। তাহলে নারীদের ব্যণিজ্যিক শিক্ষাটাও কেন তাঁরা দিয়ে গেলেন না! 


কাজেই নারীদের কর্মক্ষেত্র যদি হতো বাইরের জগত, তাহলে সেখানে ‘উম্মাহ জননীগণ’ পিছিয়ে থাকতেন না। বরং সেখানেও তাদের দেখা মিলত অগ্রজের ভূমিকায়। কিন্তু না! আল্লাহ তায়ালা তাঁদের কাঁধে এই কঠিন দায়িত্ব চাপিয়ে দেননি। চারদেয়ালে মাঝে তাঁদের কর্মক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ রেখে তাঁদের কাছে অর্পণ করেছেন মানবজাতির আগামির অমূল্য সম্পদ। সুস্থ ও আদর্শিক জাতি বিনির্মানের এক মহান গুরুভার। বাইরের কাজে তাদের নামিয়ে দিলে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে।  শিশুরা মাতৃশ্নেহহীন হয়ে পড়বে। এর অশুভ পরিণতি হবে বার্ধ্যক্যে পিত-মাতার বৃদ্ধাশ্রমে দিনাতিপাত। পৃথিবীর বরং বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোর দিকেই একটু তাকিয়ে দেখুন না! হতদরিদ্র, দিনমজুর, কিংবা অশিক্ষিত সন্তানের পিতা-মাতা কয়জন! আর উচ্চশিক্ষিত, সমাজপতি, কোটিপতি ধনকুবের পিতা কয়জন। বেশি দিন আগের কথা নয়। বিষয়টি সামজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গাজিপুরের বৃদ্ধাশ্রমই শেষ আশ্রয় হয়েছে বিলেত শিক্ষিত তিন চার সন্তানের জনক, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ জাহঙ্গীরনগনর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপকের।  (এখানে তথ্যনির্ভর একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দিতে হবে।) আগামি পঞ্চাশ বছর পর এই পরিসংখ্যান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! একটু কি ভেবে দেখেছেন?!


পরিশিষ্ট

পূর্বোক্ত আলোচনা দ্বারা আশা করি একথা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, চেহারাও পর্দার অন্তর্ভূক্ত এবং এটাই প্রণিধানযোগ্য মত। অপ্রয়োজনে নারীর জন্য, বিশেষত যুবতি নারীর জন্য পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখা জায়েজ নাই। তবে হ্যাঁ, ইসলাম যেহেতু সার্বজনীন এবং সর্বকালীন স্বভাবজাত ধর্ম এবং কোনো কালেই ইসলাম মানুষের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে না। তাই অন্য সকল বিধানের ন্যায় পর্দার আরোপের সাথে সাথে প্রয়োজনের তাগিদে ক্ষেত্র বিশেষ সেখানেও বিকল্প রাস্তা খোলা রেখেছে। ইসলাম এব্যাপারে একটি সীমারেখাও  নির্ধরণ করে দিয়েছে। কাজেই প্রয়োজন, জরুরত, অপারগতা বা যুগচাহিদার ধোঁয়া তুলে ইসলামের সেই সীমারেখা অতিক্রম করা বুুদ্ধিমানের কাজ হবে না। 


এসব বিষয়ে অভিভাবক, সমাজপতি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়ও কম নয়। তারা যদি সচেতন  হোন এবং নিজেদের তত্ত্ববধানে থাকা নারীদের প্রতি যত্নবান হোন, সাথে সাথে সমাজের সকল স্তরের মুসলিমগণ আল্লাহ তায়ালার বিধান এবং রাসুলুল্লাহ সা.-এর  সুন্নাহ মোতাবেক জীবন গঠনে উদ্যোগী হোন তাহলে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীদের জন্য একটি সুন্দর ও ইসলাম বান্ধব  পরিবেশ গড়ে তোলা মোটেও অসম্ভব নয়। আল্লাহ আমাদের বিষয়টি বুঝার এবং তদ্বনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন। 


‘জঙ্গে জামালে’ আম্মাজান আয়েশা রা.-এর নেতৃত্ব দান

ইসলামের ইতিহাসে একটি অনাকাঙ্খিত এবং দুঃখজনক যুদ্ধের নাম জঙ্গে জামাল। যা উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়শা রা.,  হজরত তালহা রা.,  হজরত জুবায়ের রা. এর মতের অনুসারী এবং হজরত আলী রা. এর বাহিনীর মাঝে সাবায়ী চক্রের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কারণে সংঘটিত হয়েছিল।

সাবায়য় চক্র হযরত ওসমান রা. কে নির্মমভাবে হত্যা করলে মুসলমানদের ঐক্যমতে হজরত আলী রা. কে খলিফা নিযুক্ত করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত খলিফা কি প্রথমে ওসমান রাঃ এর হত্যার বিচার করবেন না কি সাবাঈ চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার ইসলামী খিলাফাহকে হিফাজত করত শক্তিশালী করবেন তারপর হত্যাকারীদের বিচার করবেন, এই বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত দেখা দেয়। 

বিষয়টি নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা. দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। উম্মুল মুমিনিন   হজরত আয়েশা রা,, হজরত মুয়াবিয়া রা., হযরত তালহা রা., হযরত জুবায়ের রা.সহ প্রমূখ সাহাবীর মত ছিল আগে হজরত ওসমান রা. এর হত্যার বিচার করতে হবে। হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে হবে। তারপর শাসব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। সাবায়ীদের চাপের মুখে উপরোল্লিখিত সাহাবায়ে কেরাম প্রথমে হজরত আলী রা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করলেও পরবর্তীতে তাঁরা এই দাবিতে বাইয়াত প্রত্যাহার করে নেন। 

পক্ষান্তরে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী রা. এবং তাঁর অনুসারীদের মত ছিল আগে ষড়যন্ত্রের শিকার ভগ্নপ্রায় ইসলামী খিলাফাহকে মুক্ত করে শাসনব্যবস্থা মজবুত করা হবে। তারপর ষড়যন্ত্রকারী এবং হত্যাকারী সাবায়ীদের অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হবে। আর এর জন্য শাসন ব্যবস্থায় শীর্ষসাহাবায়ে কেরামের অংশ গ্রহন জরুরী। তা না হলে সাবায়ীদের আধিপত্য রোধ করা সম্ভব হবে না। কাজেই শীর্ষ সাহাবায়ে কেরামের বাইয়াত গ্রহন করা জরুরী। 

ওসমান রা. এর শাহাদাতের সময় হজরত আয়েশা রা. মক্কায় হজব্রত ছিলেন। হজ থেকে মদিনায় ফেরার পথে খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওসমান রা. এর শাহাদাতের সংবাদ এবং আলী রা. এর  প্রশাসনে সাবায়ীদের অধিপত্যের সংবাদ শোনে তিনি মদিনা সাবায়ীদের দখলমুক্ত করার জন্য জনমত গঠন করতে থাকেন। মদিনার অনেক শীর্ষ সাহাবায়ে কেরামও তাঁর সাথে যোগ দেন। 

মাঝে বেশকিছু ঘটনা প্রবাহ গড়িয়ে হজরত আয়েশা রা. এবং হজরত আলী রা. এর কাফেলা বসরার এক স্থানে মুখোমুখি অবস্থান করে শান্তিময় সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই চুক্তির ফলে সাবায়ী চক্র অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা যদি মুসলিমগণ ঐক্যমতে পৌঁছে যায় তাহলে সাবায়ীদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যাবে। এবং শীঘ্রই ওসমান হত্যার দায়ে তাদের কিসাসের সম্মুখীন হতে হবে। 

সাহাবায়ে কেরাম উভয় পক্ষই ছিলেন দ্বিন ও হক্কানিয়াতের পক্ষে। কোন দলই যুদ্ধ কামনা করেননি। সাবায়ীরা এটা কিছুতেই হতে দিতে চাইলো না। ফলে রাতের গভীরে তারা উভয় দলে অনুপ্রবেশ করে দুই বাহিনীর ওপর একযোগে হামলা করে বসে। সৃষ্টি হলো বিভ্রান্তির। উভয় দলের মধ্যেই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং হামলার সংবাদ ছড়িয়ে দিল। ফলে তাঁদের মাঝে বেঁধে গেল তুমুল যুদ্ধ। যদ্ধের বীভৎসতায় আশারায়ে মুবাশশারাহ (জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ সাহাবী)-র অন্যতম দুই সাহাবী  হজরত তালহা ও হজরত জুবায়ের রা. এবং হজরত তালহা রা. এর দুই ছেলেসহ উভয় পক্ষের প্রায় দশ হাজার মুসলমান শহীদ হয়। 

যুদ্ধ শেষে হজরত আলী রা. ময়দানের সকল প্রান্তে ঘুরে দেখলেন এবং নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের এই অনর্থক ও ষড়যন্ত্রমূলক লড়াইয়ের শিকার হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে তিনি অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেন এবং আফসোস করতে থাকেন। হযরত তালহা রা. এর লাশ দেখে তিনি অত্যন্ত আফসোস করে বললেন- কুরাইশ গোত্রীয় কোন ব্যক্তিকে আমি লুটে পড়ে থাকতে দেখা সহ্য করতে পারি না। অতঃপর তিনি তাঁর অনেক গুণ-কীর্তন করার পর উভয়পক্ষের শহীদগণের জানাজা পড়ান  এবং তাদের কাফন-দাফনের নির্দেশ দেন। এভাবেই সাবায়ীদের চক্রান্ত সফল হয় এবং তাদের ষড়যেন্ত্রের শিকার হয়েই সর্বপ্রথম ভাতৃঘাতি সংঘাতে মুসলিমদের হাত রক্তে রঞ্জিত হয়। ইতিহাস এই যুদ্ধকে 'জঙ্গে জামাল' নামে অভিহিত করেছে। -(ইসলামী খিলাফত ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস, ইশৎ পরিমারর্জিত) 

শেষ কথা: জঙ্গে জামালের সংক্ষিপ্ত  বর্ণনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, হজরত আয়েশা রা. নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে বের হননি। বরং তিনি হজের সফর শেষে মদিনায় ফেরার পথে কাকতালীয়ভাবে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছেন। তাছাড় জঙ্গে জামালের মূল নেতৃত্ব আয়েশা রা. এর হাতে ছিল না বরং ছিল হযরত জুবায়ের রা. এবং তালহা রা.সহ অন্য সাহাবীদের হাতে। আর এ কারণেই তো সাবায়ীরা প্রথমেই এই দুই জনকে শহীদ করে দেয়। কাজেই এটাকে নারীর জন্য যদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের দলীল হিসেবে পেশ করা নির্বুদ্ধিতা বৈকি? 

আম্মাজান খাদিজা রা.-এর বানিজ্যিক সফরের বাস্তবতা


প্রবন্ধকার:  মুফতি ছাইদুজ্জামান কাসেমী

উস্তাজুল ইফতা ওয়াল হাদিস 

জামিয়া ইমাম বুখারীউত্তরাঢাকা  



No comments

Powered by Blogger.