জঙ্গে জামাল: আয়েশা রা. কি নেতৃত্বে ছিলেন?
ইসলামের ইতিহাসে একটি অনাকাঙ্খিত এবং দুঃখজনক যুদ্ধের নাম জঙ্গে জামাল। যা উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়শা রা., হজরত তালহা রা., হজরত জুবায়ের রা. এর মতের অনুসারী এবং হজরত আলী রা. এর বাহিনীর মাঝে সাবায়ী চক্রের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কারণে সংঘটিত হয়েছিল।
সাবায়ী চক্র হযরত ওসমান রা. কে নির্মমভাবে হত্যা করলে মুসলমানদের ঐক্যমতে হজরত আলী রা. কে খলিফা নিযুক্ত করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত খলিফা কি প্রথমে ওসমান রা. এর হত্যার বিচার করবেন না কি সাবায়ী চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার ইসলামী খিলাফাহকে হিফাজত করত শক্তিশালী করবেন তারপর হত্যাকারীদের বিচার করবেন, এই বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত দেখা দেয়। ছবি: ইন্টারনেট থেকে
বিষয়টি নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা. দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা,, হজরত মুয়াবিয়া রা., হযরত তালহা রা., হযরত জুবায়ের রা.সহ প্রমূখ সাহাবীর মত ছিল আগে হজরত ওসমান রা. এর হত্যার বিচার করতে হবে। হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে হবে। তারপর শাসব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। সাবায়ীদের চাপের মুখে উপরোল্লিখিত সাহাবায়ে কেরাম প্রথমে হজরত আলী রা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করলেও পরবর্তীতে তাঁরা এই দাবিতে বাইয়াত প্রত্যাহার করে নেন।
পক্ষান্তরে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী রা. এবং তাঁর অনুসারীদের মত ছিল আগে ষড়যন্ত্রের শিকার ভগ্নপ্রায় ইসলামী খিলাফাহকে মুক্ত করে শাসনব্যবস্থা মজবুত করা হবে। তারপর ষড়যন্ত্রকারী এবং হত্যাকারী সাবায়ীদের অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হবে। আর এর জন্য শাসন ব্যবস্থায় শীর্ষসাহাবায়ে কেরামের অংশ গ্রহন জরুরী। তা না হলে সাবায়ীদের আধিপত্য রোধ করা সম্ভব হবে না। কাজেই শীর্ষ সাহাবায়ে কেরামের বাইয়াত গ্রহন করা জরুরী।
ওসমান রা. এর শাহাদাতের সময় হজরত আয়েশা রা. মক্কায় হজব্রত ছিলেন। হজ থেকে মদিনায় ফেরার পথে খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওসমান রা. এর শাহাদাতের সংবাদ এবং আলী রা. এর প্রশাসনে সাবায়ীদের অধিপত্যের সংবাদ শোনে তিনি মদিনা সাবায়ীদের দখলমুক্ত করার জন্য জনমত গঠন করতে থাকেন। মদিনার অনেক শীর্ষ সাহাবায়ে কেরামও তাঁর সাথে যোগ দেন।
মাঝে বেশকিছু ঘটনা প্রবাহ গড়িয়ে হজরত আয়েশা রা. এবং হজরত আলী রা. এর কাফেলা বসরার এক স্থানে মুখোমুখি অবস্থান করে শান্তিময় সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই চুক্তির ফলে সাবায়ী চক্র অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা যদি মুসলিমগণ ঐক্যমতে পৌঁছে যায় তাহলে সাবায়ীদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যাবে। এবং শীঘ্রই ওসমান হত্যার দায়ে তাদের কিসাসের সম্মুখীন হতে হবে।
সাহাবায়ে কেরাম উভয় পক্ষই ছিলেন দ্বিন ও হক্কানিয়াতের পক্ষে। কোন দলই যুদ্ধ কামনা করেননি। সাবায়ীরা এটা কিছুতেই হতে দিতে চাইলো না। ফলে রাতের গভীরে তারা উভয় দলে অনুপ্রবেশ করে দুই বাহিনীর ওপর একযোগে হামলা করে বসে। সৃষ্টি হলো বিভ্রান্তির। উভয় দলের মধ্যেই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং হামলার সংবাদ ছড়িয়ে দিল। ফলে তাঁদের মাঝে বেঁধে গেল তুমুল যুদ্ধ। যদ্ধের বীভৎসতায় আশারায়ে মুবাশশারাহ (জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ সাহাবী)-র অন্যতম দুই সাহাবী হজরত তালহা ও হজরত জুবায়ের রা. এবং হজরত তালহা রা. এর দুই ছেলেসহ উভয় পক্ষের প্রায় দশ হাজার মুসলমান শহীদ হয়।
যুদ্ধ শেষে হজরত আলী রা. ময়দানের সকল প্রান্তে ঘুরে দেখলেন এবং নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের এই অনর্থক ও ষড়যন্ত্রমূলক লড়াইয়ের শিকার হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে তিনি অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেন এবং আফসোস করতে থাকেন। হযরত তালহা রা. এর লাশ দেখে তিনি অত্যন্ত আফসোস করে বললেন- কুরাইশ গোত্রীয় কোন ব্যক্তিকে আমি লুটে পড়ে থাকতে দেখা সহ্য করতে পারি না। অতঃপর তিনি তাঁর অনেক গুণ-কীর্তন করার পর উভয়পক্ষের শহীদগণের জানাজা পড়ান এবং তাদের কাফন-দাফনের নির্দেশ দেন। এভাবেই সাবায়ীদের চক্রান্ত সফল হয় এবং তাদের ষড়যেন্ত্রের শিকার হয়েই সর্বপ্রথম ভাতৃঘাতি সংঘাতে মুসলিমদের হাত রক্তে রঞ্জিত হয়। ইতিহাস এই যুদ্ধকে 'জঙ্গে জামাল' নামে অভিহিত করেছে। -(ইসলামী খিলাফত ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস, ইশৎ পরিমারর্জিত)
শেষ কথা: জঙ্গে জামালের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, হজরত আয়েশা রা. নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে বের হননি। বরং তিনি হজের সফর শেষে মদিনায় ফেরার পথে কাকতালীয়ভাবে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছেন। তাছাড় জঙ্গে জামালের মূল নেতৃত্ব আয়েশা রা. এর হাতে ছিল না বরং ছিল হযরত জুবায়ের রা. এবং তালহা রা.সহ অন্য সাহাবীদের হাতে। আর এ কারণেই তো সাবায়ীরা প্রথমেই এই দুই জনকে শহীদ করে দেয়। কাজেই এটাকে নারীর জন্য যদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের দলীল হিসেবে পেশ করা নির্বুদ্ধিতা বৈকি?
No comments